পঞ্চাশ বছর পর এখনো অনেক মানুষ মনে করেন চাঁদে মানুষ নামেনি, ঘটনাটি ছিল সাজানো। এদের সংখ্যা হয়তো কম, কিন্তু চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারে অবিশ্বাস ছড়ানোর জন্য যড়যন্ত্র তত্ত্ব জিইয়ে রাখতে সেটিই যথেষ্ট! কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত মানুষ চাঁদে গিয়েছে। তবে তারও অনেক আগে ঘটে যায় এক অদ্ভুত ঘটনা। পরমাণু বোমা মেরে চাঁদকে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল আমেরিকার! টপ সিক্রেট এই প্রজেক্টের নাম ছিল ‘প্রজেক্ট এ-১১৯’।
ইতিহাস বলছে, পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকের ঘটনাটি এটি। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। সেসময়ে ‘মহাকাশ’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন প্রথমবারের মতো মহাশূণ্যে তাদের স্পুটনিক স্যাটেলাইট প্রেরণ করে, তখন আমেরিকার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে! এরপর?
সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। নিজেদের স্যাটেলাইট প্রেরণ করতে তাদের আরো অনেক সময় লাগবে, তাই শর্টকাট পদ্ধতির কথা চিন্তা করতে থাকলো আমেরিকা। চাঁদের বুকে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটানো ছাড়া পুরো বিশ্বকে চমকে দেয়ার মতো আর সহজ প্রকল্প কী হতে পারে? মহাশূন্যে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটালে পৃথিবীর পরিবেশের উপর তার কীরকম প্রভাব পড়বে, এটা নিয়ে একেবারে শুরু থেকেই আলোচনা হয়ে আসছিল।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির আর্মার রিসার্চ ফাউন্ডেশন ১৯৪৯ সাল থেকেই চাঁদ নিয়ে গবেষণা করে আসছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মহাকাশ জয়ের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, ১৯৫৮ সালের মে মাসে মার্কিন বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে সংগঠনটিকে গবেষণার দায়িত্ব দেয়া হয়। তাদের মূল কাজ- চাঁদের বুকে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তার প্রভাব পৃথিবীতে কী হতে পারে সেটা নির্ণয় করা। প্রকল্পটির নাম দেয়া হয় ‘প্রজেক্ট এ-১১৯’।
অত্যন্ত গোপন এই প্রকল্পটির কথা ফাঁস হয় ২০০০ সালে। ওই দলটির নেতৃত্বে ছিলেন লিওনার্ড রেইফেল নামে একজন বিজ্ঞানী, যিনি পরবর্তীতে নাসার অ্যাপোলো প্রোগামের ডেপুটি পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি স্বীকার করে বলেন, এটি ছিল মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি পাবলিক রিলেশান্স স্টান্টের প্রচেষ্টা। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের বুকে এমন একটি বিশাল বিস্ফোরণ ঘটানোর সম্ভাবনা যাচাই করা, যা পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে খালি চোখে দেখা যাবে এবং যা দেখে আমেরিকার সামরিক এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রা সম্পর্কে মানুষের মনে ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হবে।
ওই গবেষণা দলে আরো অন্তর্ভুক্ত ছিলেন নাসার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেরার্ড কিপার, যাকে আধুনিক গ্রহবিজ্ঞানের জনক বলে অভিহিত করা হয়। দলটির দশ সদস্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন সদস্য ছিলেন তারকাখ্যাতি পাওয়া বিজ্ঞানী ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব কার্ল সেগান। তখন অবশ্য কার্ল সেগান বিখ্যাত হয়ে ওঠেননি। তিনি তখন ছিলেন অখ্যাত এক তরুণ বিজ্ঞানী। তার পরিচয় ছিল মূলত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেরার্ড কিপারের ছাত্র হিসেবে।
রেইফেল এবং তার টিম ‘A Study of Lunar Research Flights’ শিরোনামে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন। রেইফেলের দাবি, তারা এর ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। চাঁদের বুকে ঠিক কীভাবে পারমাণবিক বোমাটি প্রেরণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দেননি। কিন্তু তিনি দাবি করেন, সে সময়ের প্রযুক্তি অনুযায়ী এটি অসম্ভব কিছু ছিল না।
নীল আর্মস্ট্রং যখন চাঁদের মাটিতে পা দিয়েছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, এটি একজন মানুষের জন্য ছোট একটি পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির জন্য বিশাল একটি লাফ। প্রজেক্ট এ-১১৯ যদি আসলেই বাস্তবায়িত হতো, তাহলে তিনি হয়তো এই কথা বলার সুযোগ পেতেন না। তার পরিবর্তে হয়তো আমরা বলতাম, এটি ছিল আমেরিকার জন্য ছোট একটি বিস্ফোরণ, কিন্তু বিশ্বের জন্য বিশাল একটি ক্ষতি।