দেশের মানুষকে আরও উন্নত টেলিযোগাযোগ সেবা দিতে ১৫ বছর আগে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) যাত্রা করেছিল। কিন্তু দুর্নীতি ও ব্যাপক অনিয়মের কারণে সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি বিটিসিএল।
সেই স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান জেডটিই। বিটিসিএল’র নিয়মবহির্ভূত দরপত্র আহ্বান ও অনৈতিকভাবে অর্জিত চুক্তির মাধ্যমে লাভবান হয়েছে বিটিসিএল’র কয়েকজন কর্মকর্তা আর জেডটিই।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, এই অনৈতিক সম্পর্কের শুরু বেশ কয়েক বছর আগে বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত এমওটিএন প্রকল্প (ডিজিটাল সংযোগের জন্য টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের আধুনিকায়ন) থেকে। সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত অন্যান্য প্রকল্পেও সেই একই অনৈতিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকে। ওই প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপ— উপজেলা স্তরের জন্য আইপি নেটওয়ার্ক এনহ্যান্সমেন্টসহ বিটিসিএল’র সব বড় প্রকল্প জেডটিই অনিয়মের মাধ্যমে বাগিয়ে নিয়েছে এবং অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান বিটিসিএলে কোনও বড় প্রকল্পে কাজের সুযোগ পায়নি।
অভিযোগ রয়েছে, সেই বিশেষ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধাভোগী একটি দল রয়েছে—তাদের মধ্যে রয়েছেন বিটিসিএল’র বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং এমওটিএন প্রকল্পের পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. রফিকুল মতিন এবং রেডিসন ডিজিটাল টেকনোলজিস লিমিটেডের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন ফারুক।
প্রকল্পের নথি থেকে জানা গেছে, ডিজিটাল কানেক্টিভিটির জন্য টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের আধুনিকীকরণে এমওটিএন নামে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বিটিসিএল ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জেডটিই’র সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে। ওই প্রকল্পের চুক্তিমূল্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আরেকটি চীনা কনসোর্টিয়াম একই প্রকল্পের জন্য ১২শ’ কোটি টাকায় বিটিসিএলকে প্রস্তাব করেছিল। তারপরও এই প্রকল্পটি সেই নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত ৮০০ কোটি টাকা বেশিতে দেওয়া হয়েছিল। এমওটিএন প্রকল্প শেষ করার পর, বিটিসিএল নিম্নমানের পণ্য এবং প্রকল্পের কাজে বিশাল বিচ্যুতির কারণে ওই প্রকল্পের মাধ্যমে কোনও রাজস্ব আয় করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সে সময়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, চীনা অর্থায়নে বাস্তবায়িতব্য সব প্রকল্পের ক্ষেত্রে সীমিত দরপত্রের মাধ্যমে চীনা প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে বর্তমান সব চীনা প্রতিষ্ঠান প্রাসঙ্গিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করার কথা থাকলেও নিয়মবহির্ভূতভাবে জেডটিই’র সঙ্গে চুক্তি করা হয়।
পরবর্তী সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ বিষয়ে বিটিসিএল’র সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. রফিকুল মতিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর ফাঁকির অনুসন্ধান শুরু করে জেডটিইতে।
এ প্রসঙ্গে জানতে বিটিসিএল’র সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. রফিকুল মতিনকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরিচয় দিয়ে ফোন করার উদ্দেশ্য জানিয়ে মেসেজ পাঠালেও সাড়া দেননি তিনি।
এখনও বিটিসিএল’র নেটওয়ার্কের মান উন্নত হয়নি। ঘরে-ঘরে বিটিসিএল’র ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। গিগাবাইট প্যাসিভ অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক (জিপিওএন) এবং ব্যাকবোন আউটসাইড প্ল্যান্ট সম্পর্কিত কাজ সম্পর্কে অনেক অভিযোগ রয়েছে। যেখানে বিক্রেতা চুক্তির তুলনায় কম কাজ সম্পন্ন করেছে এবং সেইসঙ্গে নিম্নমানের উপকরণ সরবরাহ করেছে। কিন্তু প্রকল্পের বিক্রেতা চুক্তি অনুযায়ী পুরো কাজ সম্পাদন না করে আংশিক কাজ সম্পাদনের সব সনদ প্রকল্প পরিচালকের কাছ থেকে সই করিয়ে চুক্তির পুরো টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
বিটিসিএল’র আঞ্চলিক কর্মীদের মাধ্যমে জানা যায়, প্রকল্পের টেলিকম সরঞ্জামের ত্রুটির হার প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হওয়ায় নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। প্রকৌশলীরাও অনভিজ্ঞ বলে জানা গেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বিক্রেতার কারিগরি দল ভুল করে ‘ট্রিপল এ’ সার্ভারসহ কিছু মূল নোডের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়। এ কারণে ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট সার্ভারের ডাটাবেজ নষ্ট হয়ে যায়। গ্রাহকরা প্রায় ২৪ ঘণ্টা ইন্টারনেট পরিষেবা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। পরবর্তী সময়ে এমওটিএন প্রকল্পের ফেজ-২ শুরু হলে তা বাস্তবায়নের সময় জেডটিই টেন্ডারে উল্লেখ করা সব সরঞ্জাম সরবরাহ করেনি বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, এমওটিএন প্রকল্পের ফেজ ১-এর বিদ্যমান যন্ত্রপাতি পুনরায় ব্যবহার করে আবারও সরকারি অর্থ লোপাট করে।
বিটিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. রফিকুল মতিন চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি অবসর প্রস্তুতি ছুটি (পিআরএল) গ্রহণ করেন।
বিটিসিএলে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে আসাদুজ্জামানকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রফিকুল মতিনকেও বহাল রাখার জন্য একটি মহল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও কথা উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিটিসিএলে ‘ফাইভ-জি রেডিনেস প্রজেক্ট’-এর জন্য বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের উন্নয়ন নামে একটি প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। প্রায় ছয় সপ্তাহ আগে কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদন বিটিসিএল’র ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামানের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, সাবেক একজন ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিবের সভাপতিত্বে পরিচালক পর্ষদ, বিটিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রকল্প পরিচালক এবং দরপত্রে অংশগ্রহণকারী সব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতিতে বিটিসিএল অফিসে একটি সভার আয়োজন করা হয়। দরপত্র জমাদানের শেষ তারিখের আগে আয়োজিত সেই সভায় সবাইকে আহ্বান করা হয়—তারা যেন দরপত্র বিষয়ক যেকোনও মতামত, অভিযোগ কিংবা পরামর্শ সেই সভায় বিনা দ্বিধায় উল্লেখ করেন। সেই সভায় কিংবা পরবর্তী সময়ে কোনও প্রতিষ্ঠান কোনও আপত্তি উপস্থাপন করেনি। কিন্তু দরপত্র জমা এবং কারিগরি মূল্যায়ন রিপোর্ট তৈরি হওয়ার পর হঠাৎ জেডটিই প্রকল্পটি হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে গড়িমসি শুরু করে। গত ২৪ এপ্রিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ বরাবর প্রকল্প দরপত্রের সরঞ্জামের কারিগরি সক্ষমতার বিষয়ে একটি মনগড়া অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে তারা। তাদের উদ্দেশ্য এই দরপত্রটি বাতিল করে আবারও আহ্বান করানো বলে সূত্রটি মনে করে। কিন্তু কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর দেড় মাস অতিবাহিত হলেও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান প্রতিবেদনটি অনুমোদন করতে এবং আর্থিক অফারটি খোলার অনুমতি দিতে দেরি করছেন।
বিটিসিএল’র ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামানের কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা অনেক পুরনো একটি বিষয়। এটা পিডি (প্রকল্প পরিচালক) হিসেবে আমার রোল নয়। কারণ, মন্ত্রণালয় থেকে একটা আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির মাধ্যমে কন্ট্রাক্টটি (চুক্তি) হয়েছিল। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে আমি সেটা বাস্তবায়ন করছি। ওই পিরিয়ডটি (সময়) নিয়ে কিন্তু আমি উত্তর দিতে পারবো না। একটা হলো কন্ট্রাক্ট, একটা হলো ইমপ্লিমেন্টেশন (বাস্তবায়ন)। ইমপ্লিমেন্টেশনটা নিয়ে নিশ্চয়ই আমি অ্যাকাউন্টেবল। আর কন্ট্রাক্টের বিষয়টা আগের।” এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “কন্ট্রাক্টের সময় আমিও ছিলাম, কিন্তু সেটা নিয়ে তো একা উত্তর দেওয়া যাবে না। কন্ট্রাক্ট একটা বড় কমিটির কাজ। বিষয়টা অনেক পুরনো উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিষয়টার সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনও আছে। কমিশন কমিটির সবাইকে ডেকেছে। বলতে পারেন একটা কালেকটিভ ডিফেন্স। কমিটিতে যতজন ছিলেন সবাই এটার জন্য রেসপনসিবল।”
সুত্র: বাংলাটৃিবিউন