ফেনী বার্তা : বড় গোঁফ একাত্তরেও ছিল, এখনও আছে। রঙে পরিবর্তন হয়েছে। আচার-আচরণে এখনও টগবগে তরুণ। মনে হয় রণাঙ্গনেই আছেন। মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের প্রসঙ্গ উঠলে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। চশমা খুলে চোখ মোছেন মেজর হায়দার প্রসঙ্গে। মেলাতে কষ্ট হয়, এই মানুষটি একাত্তরে কতটা দুর্ধর্ষ ছিলেন! বলছি হাবিবুল আলম বীর প্রতীকের কথা। মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ, মেজর হায়দারের গড়া ‘ক্রাক প্লাটুনে’র গেরিলা হাবিবুল আলম। একাত্তরে যারা ঢাকা শহরে বড় বড় গেরিলা অপারেশন করে পাকিস্তানিদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিলেন সেই ক্রাক প্লাটুনের সদস্য হাবিবুল আলম বীর প্রতীক। ‘ফার্মগেট অপারেশন’সহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন বিষয়ে দেশের মানুষ জানেন। হয়ত জানেন না, বা কম জানেন এই গেরিলা কখন, কীভাবে ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দিয়েছিলেন, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কীভাবে হয়ে উঠলেন দুর্ধর্ষ গেরিলা। দেশ স্বাধীনের ৪৩ বছর পরে আবার ফিরে গেছেন একাত্তরে। বলেছেন সেই সময়ের কথা। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীর প্রতীকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন
ফেনী বার্তা : সাক্ষাৎকার যেভাবে শুরু করতে চেয়েছিলাম, সেভাবে নয়। একটু মাঝখান থেকে শুরু করতে চাইছি। ফেসবুকে শিমুল ইউসুফের একটি লেখা দেখছিলাম। সেখানে আব্দুস সামাদ বীর প্রতীকের নাম বলেছেন। তিনি নাকি আলতাফ মাহমুদসহ অন্যদের ধরিয়ে দিয়েছিলেন পাকবাহিনীর হাতে। আব্দুস সামাদ বীর প্রতীক তো আপনাদের সহযোদ্ধা। প্রথমেই আপনাদের সহযোদ্ধা আব্দুস সামাদ সম্পর্কে জানতে চাই? হাবিবুল আলম: শিমুল ইউসুফ গেরিলা সদস্য আব্দুস সামাদকে নিয়ে একটি ঘটনার বেদনাদায়ক অংশটুকু বলেছেন। আব্দুস সামাদ ’৭১ সালের ২৯ আগস্ট ধরা পড়েন। ধরা পড়া গেরিলাদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় ব্যক্তি। এর আগে সকাল ১১টায় ধরা পড়েন গেরিলা সদস্য বদিউল আলম বদি (বীর বিক্রম)। বদি একসময় এনএসএফ করত। ২৭ মার্চ যে চারজন প্রথম যুদ্ধে যান, তার মধ্যে বদিও ছিলেন। অন্য তিনজন হলেন শহীদুল্লাহ খান বাদল, আসফাকুস সামাদ এবং মাসুদ ওমর। একেবারে শুরুতেই তারা কিশোরগঞ্জ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ঢাকা শহরে এই চারজনই প্রথম অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করেন। এদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট আসফাকুস সামাদ শহীদ হয়েছেন। ধরা পড়ার পর বদিকে হত্যা করা হয়। আর বছর দুই আগে মাসুদ অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। এদের মধ্যে শহীদুল্লাহ খান বাদল বেঁচে আছেন। বলছিলাম, ২৯ আগস্টে বদির ধরা পড়ার ঘটনা। ওইদিন ধরা পড়ার পর বদিই সামাদ ভাইয়ের নাম বলে দেয়। বদি ধরা পড়ে ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল জালালউদ্দিন সাহেবের বাসা থেকে। প্রিন্সিপাল জালালউদ্দিন ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের শ্বশুর। ওইদিন বদিরা জালালউদ্দিন সাহেবের বাসায় তাস খেলছিলেন। খেলার একপর্যায়ে জালালউদ্দিন সাহেবের ছেলে ফরিদ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পর আর্মি নিয়ে প্রবেশ করে। আমরা তখন ধানমন্ডির ২৮ নম্বরে। দিলারা হাশেমের বাসায়। সেখানে মাসুদ সাদেক ছুল্লু ভাইয়ের অফিস। দিলারা হাশেম বেঁচে আছেন এবং ভয়েস অব আমেরিকায় কাজ করছেন। ওই বাড়িতে আমেরিকার ওষুধ কোম্পানি ৩-এম রাইকার্স-এর অফিসও। শেল্টার নিতেই ছুল্লু ভাইকে দিয়ে সাইনবোর্ডে ইউএসএ-এর নাম বড় করে লেখালাম। ছুল্লু ভাই সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এএইচএসকে সাদেকের ছোট ভাই। বদি ধরা পড়ার পর বিকেল চারটায় সামাদ ভাইয়ের বাসায় দ্বিতীয় অভিযান চালায় পাকিস্তানি আর্মি। বাসায় ওই সময় সামাদ ভাইয়ের স্ত্রী এবং ছোট্ট একটি কন্যাশিশু ছিল। সামাদ তখন নিউ ইস্কাটনের একটি একতলা বাসায় থাকতেন।
ফেনী বার্তা : সামাদ সাহেব কী করতেন? হাবিবুল আলম: নিওন সাইনের ব্যবসা করতেন। পূর্ব পাকিস্তানে তিনিই প্রথম এই ব্যবসা শুরু করেন। সামাদ ভাই অসাধারণ গাড়ি চালাতেন। ফার্মগেট অপারেশনে সামাদ ভাই-ই নিজের গাড়ি চালিয়েছেন। ইন্টারকন্টিনেন্টালে (শেরাটন) দ্বিতীয় অপারেশনেও তিনি অংশ নেন। ইন্টারকন্টিনেন্টালে এই অপারেশন ছিল ১১ আগস্ট।
ফেনী বার্তা : সামাদ সাহেবকে নিয়ে বলছিলেন? হাবিবুল আলম: সামাদ ভাইয়ের সামনে তখন দুটি বাস্তবতা। স্ত্রী-ছোট্ট মেয়েকে ভয় দেখাচ্ছে পাকিস্তানি আর্মিরা। এই অবস্থায় কী করার আছে? কঠিন বাস্তবতা। আমাদের সবার কাছেই ‘সায়ানাইড’ ট্যাবলেট থাকার কথা। কিন্তু নিজের জীবন সহজেই শেষ করে দেয়া যায় না। আবার ওর সামনে আরও দুটি জীবন ছিল। এখন ভাবি, ওমন অবস্থায় অন্যদের নাম বলে দেয়াটাই খুব অস্বাভাবিক ছিল না তার জন্য। এতে আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়। সহযোদ্ধারা ধরা পড়ে যায়। অস্ত্র-গোলাবারুদ, ঢাকায় আমাদের আস্তানা সবকিছু পাকিস্তানি বাহিনীর জান�� হয়ে যায়। যুদ্ধের পর মনে হয়েছে সামাদ ভাইকে সামনে পেলেই শেষ করে দেব।
ফেনী বার্তা : তিনি কাদের নাম বলেছিলেন? হাবিবুল আলম: আলতাফ মাহমুদ, রুমিসহ অধিকাংশের নামই তিনিই বলে দেন। ফেনী বার্তা : এদের ধরার অভিযানের সময় সামাদ সাহেব কি পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গেই ছিলেন? হাবিবুল আলম: হ্যাঁ। আলতাফ মাহমুদের বাড়িতে অভিযানের সময় সামাদ ভাই সঙ্গে ছিলেন। তিনিই আলতাফ মাহমুদকে দেখিয়ে দেন। একটি প্রশিক্ষত গোয়েন্দা বাহিনীর পক্ষে তথ্য বের করা খুব কঠিন কাজও বলে আমি মনে করি না। একটি আঙুলের নখ ধরে টান দিলেই অনেকে যে কোনো তথ্য বলে দেবে।
ফেনী বার্তা : : অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যেমন, আবুল বারাক আলভীও নির্যাতনের শিকার। তিনি তো তথ্য ফাঁস করেননি? হাবিবুল আলম: আলভী সব জানতেন না। কিন্তু সামাদ ভাই অনেক কিছুই জানতেন। তার কাছে সবই চেনা ছিল।
ফেনী বার্তা : : সামাদ সাহেব সব অপারেশনেই ছিলেন? হাবিবুল আলম: না। সব অপারেশনেই তিনি অংশ নেননি। তবে অনেক অপারেশনেই ছিলেন। এর মধ্যে বড় একটি অপারেশনে অংশ নেন। ফার্মগেট অপারেশনে ছিলেন। ইন্টারকন্টিনেন্টালে দ্বিতীয় অপারেশনেও অংশ নেন। বাকীকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। বাকীর ও আমাদের দরকার ছিল সুইচ-এর ম্যানেজার হাকিম সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার জন্য। ব্যাগ নিয়ে ভিতরে যেতাম, গল্প করতাম। ছকে বাঁধা কিন্তু ফিল্মি স্টাইলে ওই অপারেশনটা করি।
ফেনী বার্তা : : আলতাফ মাহমুদ, রুমিদের হত্যা করা হলো। সামাদ সাহেব বেঁচে গেলেন কীভাবে? তিনি কি রাজসাক্ষী হয়েছিলেন? হাবিবুল আলম: রাজসাক্ষী বলা ঠিক হবে না, কিন্তু অন্যদের চিনিয়ে দেয়ার কাজটি তিনিই করেছিলেন। এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন ছুল্লু ভাই।
ফেনী বার্তা : : ছুল্লু ভাই বেঁচে গেলেন কীভাবে? হাবিবুল আলম: ছুল্লু ভাই প্রথম থেকেই এক অবস্থানে ছিলেন। ধরা পড়ার পর তিনি প্রথম থেকেই বলে এসেছিলেন যে, তিনি কিছুই জানেন না। শত নির্যাতনের পরেও একই অবস্থানে থাকেন। ছুল্লু ভাইয়ের শরীরের এমন কোনো জায়গা ছিল না যেখানে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়া হয়নি।
ফেনী বার্তা : : এখানেই তুলনার প্রশ্ন আসে কি না? হাবিবুল আলম: শিমুল ইউসুফ হয়ত এমন তুলনা করেই বর্ণনা করেছেন। নির্যাতনের মুখে একজন সবই বলে দিল আরেকজন শেষ পর্যন্তও মুখ খুললেন না।
ফেনী বার্তা : : সব বলে দিয়েই সামাদ সাহেব বেঁচে গেলেন? হাবিবুল আলম: হ্যাঁ। নাম বলে দিয়ে বেঁচে গেলেন সামাদ ভাই। হয়ত শিশুকন্যা, স্ত্রীর কথা ভেবেই তিনি নাম বলে দিয়েছিলেন। তিনি নাম বলে বড় অন্যায়, অনেক বড় ক্ষতি করেছিলেন। এ কথা পূর্বেই বলেছি। শিমুল ইউসুফসহ আমাদের সবারই প্রত্যাশা, যত নির্যাতনই হোক না কেন, কেউ অন্য কারও নাম বলবেন না। এই প্রত্যাশা থাকাটাই স্বাভাবিক। শিমুল এখন সামাদ ভাইকে নিয়ে যা লিখছেন, আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। শিমুলের মনে এই ভাবনা আসবেই যে, সেদিন যদি সামাদ ভাই আলতাফ মাহমুদকে ধরিয়ে না দিতেন, তাহলে হয়ত এখনও তিনি বেঁচে থাকতেন। কিন্তু সবাই তো সব প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেন না। সামাদ ভাইয়ের চেয়েও বেশি নির্যাতন করা হয়েছিল ছুল্লু ভাইকে। ছুল্লু ভাইও আমাদের সবকিছু জানতেন। তিনি কিছুই বলেননি। ছুল্লু ভাই পেরেছিলেন, সামাদ ভাই পারেননি। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু সামাদ ভাইয়ের যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান, সেটাও তো বাস্তবতা। আমরা তো অস্বীকার করতে পারব না তার অবদানের কথা। আমি মনে করি যা সত্যি, যতটুকু সত্যি, সেটা অবশ্যই আমাদের বলা উচিত। সেই সময় সামাদ ভাই সম্পর্কে যতটা কঠোর, ক্ষিপ্ত মনোভাব পোষণ করতাম, এখন আর অতটা করি না। কারণ তার দিকের বিষয়গুলোও এখন আমার ভাবনায় আসে। সেই বিষয়গুলোকে একেবারে গুরুত্ব না দিয়ে পারি না। ফেনী বার্তা : : সামাদ সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ আছে? হাবিবুল আলম: হ্যাঁ। তবে খুব বেশি না। তিনি উত্তরায় মেয়ের বাসায় থাকেন। বয়স হয়ে গেছে।
ফেনী বার্তা : : এ নিয়ে আর কখনও কথা হয়নি? হাবিবুল আলম: না। আমি মনে করি, এ নিয়ে আর কথা বলা ঠিক না।
ফেনী বার্তা : : কখনও জানতে ইচ্ছে হয়নি যে, তার বলে দেয়ার কারণেই আপনার বন্ধুরা মারা গেলেন? হাবিবুল আলম: আমরা তো সবই জানি। ভেতরের সব ঘটনাই আমাদের কাছে স্পষ্ট। নতুন করে তার কাছ থেকে আর জানার কী দরকার।
ফেনী বার্তা : : সামাদ ভাইয়ের মাঝে অনুশোচনা লক্ষ করেছেন? হাবিবুল আলম: এ ঘটনায় আমরা খুবই ক্ষিপ্ত ছিলাম। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত আমরা তার ওপর খ্যাপা ছিলাম। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি। সাক্ষাৎ হলে হয়ত অন্যকিছুও হয়ে যেতে পারত। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি হয়ত।
ফেনী বার্তা : : পরে তার মধ্যে কোনো অপরাধবোধ বা অস্থিরতা কাজ করেনি? হাবিবুল আলম: তিনি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন। তার অবদানের জন্যই এমন সম্মাননা। এখানে কোনো ঘাটতি আছে বলে মনে করি না। এরপরও তার মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে না, তা বলা যাবে না। আমরা জীবনের আনন্দটুকু প্রকাশ করি।
ফেনী বার্তা : : আপনি মুক্তিযুদ্ধে কবে গিয়েছিলেন? হাবিবুল আলম: এপ্রিল মাসের ৮ অথবা ৯ তারিখে।
ফেনী বার্তা : : কেন গেলেন? হাবিবুল আলম: রাষ্ট্রের বৈষম্য, নিপীড়ন, নির্যাতন দেখছিলাম। পাকিস্তান তো এই জন্য সৃষ্টি হয়নি। এমন একটি যুদ্ধে যাব বলেই হয়ত অপেক্ষায় ছিলাম।
ফেনী বার্তা : : বৈষম্য, নির্যাতন তো আপনাকে স্পর্শ করেনি। শহুরে সচ্ছল পরিবারের সন্তান। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করেছেন। আপনার তো নিরাপদ জীবন। যুদ্ধে যাওয়ার ঝুঁকি নিলেন কেন? হাবিবুল আলম: মওলানা ভাসানীর বক্তব্য, কথা দারুণ অনুপ্রাণিত করেছিল। যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৭০ সালে আমি স্কাউটের একটি দল নিয়ে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলাম। যুদ্ধে যাওয়ার এটিও একটি অনুপ্রেরণা। আমি রাজনীতি অনুধাবন করেছি বটে, কিন্তু অন্যদের মতো জড়িত ছিলাম না। আমি রাষ্ট্র, সমাজের দুটি দিকই লক্ষ করছিলাম। একটি পক্ষ সুবিধা পাচ্ছে, আরেকটি পক্ষ কিছুই পাচ্ছে না। আমি হয়ত নিজেও সুবিধা পাওয়ার দলে। কারণ, আমি রেসিডেনসিয়াল স্কুলের ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র। ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে ভর্তি হই। ঢাকায় জন্ম। এরপরেও যুদ্ধে যাওয়ার আর কোনো বিকল্প আমার কাছে ছিল না।
ফেনী বার্তা : : কয় ভাইবোন আপনারা? হাবিবুল আলম: আমরা দুই ভাই, চার বোন। তবে অনেক আগেই বড় ভাই মারা যান। ফেনী বার্তা : : পরিবারের একমাত্র ছেলে, তবুও যুদ্ধে গেলেন। যুদ্ধের জয়-পরাজায় নিয়ে অনিশ্চয়তা কাজ করেনি? হাবিবুল আলম: ৯ মাসে দেশ স্বাধীন হবে, তা কখনোই ভাবিনি। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য জয়ই একমাত্র অনুষঙ্গ নয়। এটি হচ্ছে দায়ের ব্যাপার। ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহিদ মিনারে যেতাম। মিছিল-সমাবেশে অংশ নিতাম। মধুর ক্যান্টিনে আনাগোনা করতে থাকি। এটি আমার ভেতরে ভীষণভাবে আন্দোলিত করতে থাকে। কাজী জাফর, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেননের বক্তব্য শুনতাম। তারা ক্যাম্পাসের আইকন। বই পড়া শুরু করলাম। মাও সেতুং-এর বই। বেশ ভালোই লাগছিল। মগজ প্রস্তুত হচ্ছে তা বুঝতে পারছিলাম। আবার স্কাউটের সঙ্গে থেকে পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিভাজনটা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। পাকিস্তানি আর্মি সম্পর্কেও ধারণা পরিষ্কার হতে থাকে। এদিকে ১৯৭০ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি, প্রচার- সব মিলে অন্যরকম আবহ তৈরি করতে থাকলো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই সমাধান হয়ে যাবে, এটি ভাবিনি। ভেবেছি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বাঙালি ক্ষমতায় আসবে। কারণ মওলানা ভাসানী ছাড়া কেউই তখন পাকিস্তানকে বিদায় জানায়নি। সত্যি কথা বলতে কী, মানুষকে আকর্ষণ করার মওলানা ভাসানির জাদুকরী ক্ষমতা ছিল। একজন লুঙ্গিপরা মানুষ বক্তৃতায় এভাবে তরুণ সমাজকে উজ্জীবিত করতে পারে, তা ভাবা যায় না।
ফেনী বার্তা : : যুদ্ধে যাওয়ার কথা পরিবারকে বলেছিলেন? হাবিবুল আলম: না। বলার প্রয়োজন মনে করিনি। বলতে গেলে বিপত্তি হতে পারত। যেতে দিত না। আমার বড়ভাই মারা গেছেন ১৯৬০ সালে। দশ বছর ধরে চার বোনের মাঝে আমি একা। এমন অবস্থায় চাইলেই পরিবার থেকে কেউ বলে-কয়ে যেতে পারে না।
ফেনী বার্তা : : কীভাবে বের হলেন? হাবিবুল আলম: ভোর চারটার দিকে বেরিয়ে যাই। একটি চিরকুট লিখে গিয়েছিলাম। আমি ওপর তলায় থাকতাম। কোলবালিশটাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলাম যাতে কেউ দেখলে বুঝতে পারে যে, আমিই শুয়ে আছি। আমি জানি, দুই ঘণ্টা সময় পেলেই আমি বেরিয়ে যেতে পারব। ওপর তলা থেকে দেয়াল টপকে নেমেছি।
ফেনী বার্তা : : বের হয়ে কোথায় গেলেন? হাবিবুল আলম: বায়তুল মোকাররমের কাছে স্কাউট অফিসে গেলাম। সেখান থেকে গেলাম হাটখোলাতে। হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির উল্টো দিকে পেট্রল পাম্পে দাঁড়ালাম। ঢাকা থেকে বের হওয়ার এটিই ছিল শেষ পেট্্রল পাম্প। চট্টগ্রাম-কুমিল্লা যাওয়ার প্রায় সব বাসই এখানে তেল নেয়ার জন্য দাঁড়াত। আমার আগে আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন গিয়েছিলেন। তিনি ফেরত এসেছেন আমাদের নেয়ার জন্য। মেজর হায়দার ভাই আলি আহমেদ জিয়াউদ্দিন ও আসফাকুস সামাদকে ঢাকায় পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রদের নেয়ার জন্য।
ফেনী বার্তা : : পেট্রল পাম্প থেকে কোথায় গেলেন? হাবিবুল আলম: আমাদের সবারই পেট্রল পাম্পের কাছে আসার কথা। আব্দুল কাউয়ুম খান, ভাসন, শ্যামল, হেলাল আসলেন। জিয়াসহ আমরা ছয়জন বাসে উঠলাম। তখন ভোর হয়ে গেছে। কুমিল্লার নিমসা হয়ে বেরিয়ে গেলাম। নিমসা পর্যন্ত বাসে গেলাম। এরপর একটু রিক্সায় গিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। শ্যামপুর বাজার হয়ে বর্ডার ক্রস করলাম। এরপর মতিনগর বাজারে পৌঁছালাম। তখন প্রচণ্ড ক্ষুধা। দোকানদেরকে বললাম, এক সের মিষ্টি ও ডিম দাও। দোকানদার অনেক সময় ধরে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমরা মিষ্টি খাওয়ার পর হাতে বানানো রুটি খাচ্ছি। এই সময় দেখলাম, একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট জিপ চালিয়ে এসে নামলেন। তিনি দোকানদারের কাছে একই খাবার চাইলেন। তিনি ছিলেন ফজলুল কবির। মেজর ফজলুল কবিরের বাসা ছিল গোপীবাগে। জাঙ্গেল বুট পরা। দেবিপুরের ইনচার্জ ছিলেন। আমাদের সঙ্গে পরিচয় হলো। আমরা বললাম, সেক্টর টু-এ যাব। জিয়া বললেন, আমাদের সেক্টর টু-এ নামিয়ে দিন। তার গাড়িতেই সেক্টর টু-এ গেলাম।
ফেনী বার্তা : : কোনো বিশেষ ঘটনা, যা আপনাকে আরও বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল? হাবিবুল আলম: ২৭ মার্চ। মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠ রেডিওতে শোনার পর মনোবল হাজার গুণ বেড়ে যায়। ভাবলাম, বাঙালি সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, বিদ্রোহ করেছে, আমাদের আর বসে থাকার সময় নেই। মেজর জিয়ার বার্তা রক্তে অন্যরকম তেজ তৈরি করে।
ফেনী বার্তা : : তখন কী আপনি সেক্টর টু, খালেদ মোশাররফ সম্পর্কে অবগত ছিলেন? হাবিবুল আলম: না। কিছুই জানি না। ১ এপ্রিল চলে গিয়েছিল আলী আহমেদ জিয়া। সে যখন ফিরে এসে বলল যে, খালেদ মোশাররফ, কমান্ডো ক্যাপটেন হায়দারও বিদ্রোহ করেছে। আমরা আরও শক্তি পেলাম। কারণ আমার ধারণা ছিল মেজর জিয়াউর রহমানই শুধু বিদ্রোহ করেছেন। সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে তিনিই তো রেডিওতে ঘোষণা দিয়েছেন। আলী আহমেদ জিয়াকে বললাম, আর বসে থাকার সময় নেই। চলো। এটিই ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের প্রথম ব্যাচ।
ফেনী বার্তা : : সেক্টর টু-এ গিয়ে কার দেখা পেলেন? হাবিবুল আলম: প্রথমেই গিয়ে ক্যাপ্টেন মাহবুবের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি যুদ্ধেই শহিদ হয়েছেন। তিনি আমাদের ২নং প্লাটুনে পাঠালেন। ১ নং প্লাটুন পূর্ণ হয়ে গেছে। ১ নং প্লাটুনের দায়িত্বে তখন এম এ আজিজ। ১৯৭১ সালে তিনি ছাত্রলীগের হয়ে ঢাকা কলেজের ভিপি নির্বাচিত হন। তিনি মারা গেছেন। আমরা যাওয়ার পর ২ নং প্লাটুন গঠন হয়ে গেল। রাতে খাওয়া হলো, গল্প হলো। এর পরের দিন ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা মিলল। তার নাম আগেই শুনেছি। ফেনী বার্তা : : তার ব্যাপারে কী জানলেন? হাবিবুল আলম: তিনি সেনাবাহিনীর অফিসারদের মতো ছিলেন না। সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতেন। তিনি আমাদের দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘তোমরা এসছো খুবই ভালো হয়েছে। আমরা খুব প্রত্যাশা করেছিলাম।’ খোঁজ খবর নিলেন। কোন রাস্তা দিয়ে এসেছি, কী কী দেখেছি জানতে চাইলেন। এই প্রশ্নগুলো সাধারণত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স ছাড়া কেউ করে না। এরপর বললেন, কাল-পরশু খালেদ মোশাররফ আসবেন।
ফেনী বার্তা : : খালেদ মোশাররফ কোথায় থাকতেন? হাবিবুল আলম: একটি খালের এপার থাকতাম আমরা আর ওপারে থাকত ফোর্থ বেঙ্গলের সদস্যরা। এপারে আমরা সবাই ছাত্র। ওপারে প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী। খালেদ মোশাররফ ওপারেই থাকতেন। তিনি তখন বিভিন্ন জায়গায় মিটিং করে বেড়াচ্ছেন। একদিন পর তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমরা লাইনে দাঁড়িয়েছি। দেখি তিনটি জিপ গাড়ি আসছে। একটি জিপ থেকে খালেদ মোশাররফ নামতেই ক্যাপটেন মাহবুব সেল্যুট দিয়ে রিসিভ করলেন। ধবধবে সাদা। সবুজ ইউনিফর্ম পরা। পাকিস্তানি আর্মির পোশাক ছাড়ছেন বলেই হয়ত এই পোশাক। কালো ট্রাউজার। কাউবয় সিনেমার নায়কের মতো বেল্ট বাঁধা। কোমরে পিস্তল ঝুলানো। নেমেই সিগারেট ধরালেন। পরের গাড়ি থেকে ব্যারিস্টার মুনসুর ভাই নামলেন। মেজর জেনারেল মঞ্জুরের বড় ভাই। এখনও বেঁচে আছেন। এর পরের গাড়ি থেকে নামলেন শহীদুল্লাহ খান বাদল, বজলুল হক দিপু। দিপু ছিলেন খালেদ মোশাররফের শ্যালক।
ফেনী বার্তা : : শহীদুল্লাহ খান বাদল আসবেন জানতেন? হাবিবুল আলম: না। তাকে দেখে ধরে পানি এলো। আর আমরা পাঁচজন তো একে অপরকে চিনি। খালেদ মোশাররফ প্রায় ৪৫ মিনিট বক্তব্য রাখলেন।
ফেনী বার্তা : : কেমন কথা বলতেন? হাবিবুল আলম: তিনি বাংলা এবং ইংরেজি দুটোই চমৎকার বলতেন। বাংলা-ইংরেজি মিলিয়েই বক্তব্য রাখলেন। তিনি মাও সেতুংকে উদ্ধৃতি করে বললেন, ‘কোনো সরকারই জীবিত গেরিলাদের চায় না। তিনি বললেন, এখনই তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যুদ্ধ করবে কি করবে না। যুদ্ধ না করে এখন ফেরত গেলে তোমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু যুদ্ধের মাঝে ফেরত গেলে মারা পড়বে।’ একেবারে পরিষ্কার করে বললেন। তিনি বললেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ছেলে চাই। তোমাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে এবং যোগ্য করে গড়ে তোলা হবে। হায়দার ভাইও দিকনির্দেশনা দিলেন। কষ্ট করতে হবে, দেশ স্বাধীন করতে হবে।
ফেনী বার্তা : : থাকব না ফিরে যাব, কারও মধ্যে দ্বিধা কাজ করেনি? হাবিবুল আলম: না। কারও মাঝে দ্বিতীয় পথ বেছে নেয়ার মানসিকতা ছিল না। আমরা প্রস্তুত হয়েই গিয়েছি। ফিরে আসব কেন? আমরা প্রথম ১৭ জনের যে ব্যাচ ঢাকায় আসি তাদের মধ্যে রেজা নামের একজন বন্ধুকে ছেড়ে দিতে হয়। কারণ, তার আলসার ধরা পড়ে। এখন যদি তুমি আমাকে প্রশ্ন কর যে, খালেদ মোশাররফের বক্তব্য কী ছিল, আমি বলব একেবারে হ্যাঁ এবং না বলার সিদ্ধান্ত নেয়ার চূড়ান্ত সন্ধিক্ষণ ছিল। এ দুটির বাইরে আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমরা তার কথায় মুগ্ধ। বিশেষ করে আমরা যারা ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র তারা আরও কাছাকাছি হতে পারলাম।
ফেনী বার্তা : : ক্যাপ্টেন হায়দারের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ নিতে থাকলেন? হাবিবুল আলম: হ্যাঁ। আমরা বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে প্রশিক্ষণ নিতে থাকলাম।
ফেনী বার্তা : : এর আগে কখনও বন্দুক চালিয়েছেন? হাবিবুল আলম: হ্যাঁ। যখন স্কাউট করতাম তখন ক্যান্টনমেন্টের মাধ্যমে ফায়ারিংয়ে গিয়েছিলাম।
ফেনী বার্তা : : মেজর হায়দার সম্পর্কে কী বলবেন? হাবিবুল আলম: মেজর হায়দার ভাই বলার চাইতে কথা শুনতে পছন্দ করতেন। তাকে আকর্ষণের অন্যতম কারণ ছিল তার কাছে সব কথাই বলা যেত। বোমা বানানোর কলাকৌশলগুলো তিনি প্রত্যেককে একেবারে হাতে ধরিয়ে ধরিয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। প্রশিক্ষণের জটিল টার্মগুলো তিনি শেখাতেন। অন্য কেউ হলে আমরা হয়ত এভাবে শিখতে পারতাম না। এ কারণে আমাদের হয়ত ভুল কম হয়েছে। অধিকাংশ অপারেশনই ঠিকঠাকমতো করতে পেরেছি। দুই নম্বর সেক্টরে তো পরে আমাদের অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। শাহাদত চৌধুরীসহ আরও অনেকের সঙ্গে।
ফেনী বার্তা : : শাহাদত চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় কীভাবে? হাবিবুল আলম: শাহাদত চৌধুরীর লেখার সঙ্গে আমরা আগে থেকেই পরিচিত ছিলাম। ‘দৈনিক ইত্তেফাকে’ আরও কোনো কোনো পত্রিকায় তার লেখা পড়েছি। যদিও পরে তার সঙ্গে মায়ের তরফ থেকে আত্মীয়তার সম্পর্ক বের হয়। শাহাদত ভাই মূলত পেইন্টার ছিলেন। এরপর তিনি সাংবাদিক। তিনি একটি চোখে ঠিকমতো দেখতে পেতেন না। তবুও অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। সিদ্ধান্ত নিতেন খুবই দৃঢ়তার সঙ্গে।
ফেনী বার্তা : : যেমন? হাবিবুল আলম: আমরা অনেক কিছুই করতে চেয়েছি কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছেন। পরে দেখেছি, বাতিল করাই ভালো ছিল। আবার তিনি যে কাজ করতেন, তা খুবই অনড় থেকে করতেন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের জন্ম। শাহাদত ভাই বললেন, আজ বাংলাদেশের পতাকা উড়াতে হবে। ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে আমরা পতাকা উড়ালাম। বাংলাদেশের পতাকা দেখে পাকিস্তানি আর্মিরা ক্ষিপ্ত হয়ে পতাকায় সমানে গুলি করতে শুরু করল।
ফেনী বার্তা : : আপনারাই আয়োজন করতেন? হাবিবুল আলম: মূলত শাহাদত ভাই সিদ্ধান্ত দিত। আমরা পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, মানিক মিয়া এভিনিউসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পতাকা উড়াতাম। আমার বোন আসমা, রেশমা, শাহনাজ, শাহাদত ভাইয়ের বোন ডানা, ঝিলমিল পতাকা বানাতেন।
ফেনী বার্তা : : কেন উড়াতেন? হাবিবুল আলম: পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে কষ্ট দেয়ার জন্যই উড়াতাম। ঢাকার মানুষ যাতে বুঝত আমরা আছি এবং কিছু একটা হচ্ছে, হবে। ছোট ছোট পতাকা দুটি বেলুনে বেঁধে উড়িয়ে দিতাম। কাজটা খুবই ছোট। কিন্তু তাৎপর্য অনেক বড়। একটি রাষ্ট্রে আরেকটি রাষ্ট্রের পতাকা উড়ছে এটি অনেক বড় ব্যাপার।
ফেনী বার্তা : : আপনি তো শাহাদত ভাইয়ের আগেই প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন। হাবিবুল আলম: হ্যাঁ। সোনামোড়া থেকে শাহাদত ভাইকে খালেদ মোশাররফ সঙ্গে নিয়ে এলেন। শাহাদত ভাই সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে সুলতানা কামাল ও সাঈদা কামালকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। সেখান থেকেই খালেদ মোশাররফ শাহাদত ভাইকে গাড়িতে উঠিয়েছেন। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে সেখানেই শাহাদত ভাইয়ের প্রথম দেখা।
ফেনী বার্তা : : প্রথম দেখাতেই খালেদ মোশাররফের গাড়িতে? হাবিবুল আলম: এর পেছনে কারণ ছিল। খালেদ মোশাররফ শাহাদত ভাইকে ডেকে বললেন, ‘শোনো শিল্পী আমি ঢাকাকে গোরস্থান বানাতে চাই। একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাই।’ শাহাদত ভাই বললেন, ‘কাদেরকে দিয়ে মিশিয়ে দেবেন?’ ‘কেন তোমাদের দিয়ে, ছাত্রদের দিয়ে।’ শাহাদত ভাই বললেন, ‘ছাত্ররা কি এখানে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছেন তাদের বাবা-মাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে? তারা কী তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করতে এখানে এসেছেন? আপনি কি আপনার মা-মেয়েকে হত্যা করতে চান? আপনি এটি করতে পারেন না।’ খালেদ মোশাররফ থমকে গেলেন। প্রথমবারের মতো কোনো সিভিলিয়ান খালেদ মোশাররফের সঙ্গে যুদ্ধের তর্কে জড়ালেন। সেখান থেকেই শাহাদত ভাইয়ের সঙ্গে খালেদ মোশাররফের পরিচয় এবং ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মৃত্যুর আগ পর্যন্তও নিবিড় সম্পর্ক ছিল।
ফেনী বার্তা : : এভাবেই খালেদ মোশাররফের গাড়িতে চড়া? হাবিবুল আলম: হ্যাঁ, তখন খালেদ মোশাররফ কিছুক্ষণ শাহাদত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বললেন, শিল্পী তুমি আমার সঙ্গে চল। তোমার এখানে থাকতে হবে না। শাহাদত ভাই আসবে এটি বাদল আমাদের কাছে আগেই বলেছিলেন। শাহাদত ভাই ছিলেন ফতেহ আলীর বড় ভাই।
ফেনী বার্তা : : ফতেহ আলী চৌধুরী কী আপনাদের সঙ্গেই ছিলেন? হাবিবুল আলম: ফতেহ আলী ছিল থার্ড প্লাটুনে। মায়া, গাজি, সিরাজ, কাজী কামাল উদ্দিন ওরা ছিল একই প্লাটুনে।
ফেনী বার্তা : : প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকায় এলেন। আপনার অভিযান, পরিকল্পনা কীভাবে চলত? হাবিবুল আলম: শাহাদত ভাই মূলত আমাদেরকে সমন্বয় করতেন। ঢাকায় প্রথম যে লিফলেট প্রচার করা হয় সেটা শাহাদত ভাইয়ের করা।
ফেনী বার্তা : : কী ছিল লিফলেটে? হাবিবুল আলম: শুরুতে পরিকল্পনা ছিল ঢাকা থেকে সবাইকে বের করে গোরস্থান বানিয়ে ফেলার। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে গেল। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে শাহাদত ভাইয়ের সেই কথোপকথন এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখল। ঢাকা থেকে সবাইকে বের করে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা হলো। প্রথমবারের মতো লিফলেটে আহ্বান জানানো হলো, ‘আপনারা সবাই ঢাকা থেকে বেরিয়ে যাবেন না। ঢাকায় থাকেন, গেরিলা যোদ্ধাদের সহায়তা করেন। এই গেরিলারা আপনাদেরই সন্তান। তারা আপনাদের জন্যে, দেশের জন্যে যুদ্ধ করছেন।’ এরকম দশ-বারোটি আহ্বান জানিয়ে শাহাদত ভাই একটি লিফলেট লিখলেন। খালেদ মোশাররফ ঠিক করে দিলেন। তখনকার, লেটার প্রেসে ছাপলেন শাহাদত ভাই। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়া হলো সেই লিফলেট। ঢাকায় যারা ছিলেন, যাদের কাছে পৌঁছল এই লিফলেট, তাদের ভেতরে আশাবাদ তৈরি হলো। কিছু একটা হচ্ছে, হবে। ফেনী ফেনী বার্তা : : লিখেছিলেন একাই? হাবিবুল আলম: শাহাদত ভাই একাই লিখতেন। শাহাদত ভাই লিখতেন, খালেদ মোশররফ ঠিক করে দিতেন। খালেদ মোশাররফ ১৯৫৫ সালের দিকে ছাত্রলীগ ঢাকা কলেজের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। শাহাদত ভাই একটি বাংলা বানান ভুল করেছিলেন, সেটি আবার খালেদ মোশাররফ ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা তা দেখে হাসতাম আর বলতাম, ‘দেখ যুদ্ধের ময়দানে এরা বানান নিয়ে ব্যস্ত।’
ফেনী বার্তা : : লিফলেট বিতরণ করার পর মানুষের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলেন? হাবিবুল আলম: সবার মধ্যেই এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এল। মানুষ ধারণা করতে থাকল যে, পাল্টা কিছু একটা হতে যাচ্ছে। অন্তত মানুষের চিন্তার জায়গায় পরিবর্তন আসতে থাকল।
ফেনী বার্তা : : আপনারা ঢাকায় এলেন কবে? হাবিবুল আলম: মে মাসের শেষের দিকে প্রশিক্ষিত ১৭ জনের একটি টিম নিয়ে আমরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। ১ জুন ঢাকায় এলাম। টিমের নেতৃত্ব আমাকেই দেয়া হলো।
ফেনী বার্তা : : সঙ্গে কী অস্ত্র ছিল? হাবিবুল আলম: ভারী অস্ত্র ছিল না। গ্রেনেড ছিল।
ফেনী বার্তা : : ঢাকায় প্রথম ঢুকলেন? হাবিবুল আলম: এর আগে আমি এবং কাজী কামাল এসেছিলাম নুরুল ইসলাম শিশুর স্ত্রীকে নিতে। এর আগে কাজী কামাল, কাইয়ুম এসেছিল শাফায়াত জামিলের স্ত্রীকে নেয়ার জন্য। এরও আগে বাদল এবং কাজী কামাল এসেছিলেন খালেদ মোশাররফের স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে নেয়ার জন্য। কিন্তু খালেদ মোশাররফের এক মেয়েকে নিতে পারেননি। ছোট্ট মেয়ে, কান্না করতে করতে ঘরের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল। ওকে আর বের করার সময় পাওয়া যায়নি।
ফেনী বার্তা : : অপারেশনের জন্য ঢাকায় এলেন। কীভাবে এলেন? হাবিবুল আলম: আমরা নৌকায় করে সোয়ারি ঘাটে নামলাম। প্লান অনুযায়ী আমরা একেকজন একেক দিকে চলে গেলাম। আমি বাসায় চলে এলাম। মায়ের সঙ্গে এর আগে মাত্র ১ ঘণ্টার সাক্ষাৎ করেলিাম। মায়ের সঙ্গে দেখা করতেই অস্থির হলাম।
ফেনী বার্তা : : প্রথমে এলে আবার যেতে মা বাধা দেননি? হাবিবুল আলম: না। এর কারণ ছিল, মা জানতেন যে আমি বাধা শুনব না। বাবা-বোনেরাও বাধা দেয়নি।
ফেনী বার্তা : : গ্রেনেড নিয়েই বাড়ি এলেন? হাবিবুল আলম: হ্যাঁ। ওই প্রথম বাড়িতে গ্রেনেড রাখা শুরু হলো। তবে আমাদের বলে দেয়া ছিল আমরা যেন আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে না যাই।
ফেনী বার্তা : : সোয়ারি ঘাট থেকে দিলু রোডের বাসায় এলেন, রাস্তায় আর্মি দেখেননি। হাবিবুল আলম: দেখেছি। সাধারণ মনে করেই আমাদের আটকায়নি। গ্রেনেড রেখেছিলাম রিক্সার সিটের নিচে।
ফেনী বার্তা : : বাসায় এসেই পরিকল্পনা করেছেন? হাবিবুল আলম: প্রথমবার আমরা বাইরে বসি। কোনো বাড়িতে নয়। ভাসন ছিল আমাদের সঙ্গে। এ মাসুদ সাদেক ছুল্লু ভাইসহ আমরা আস্তানা ঠিক করেছি। ভাসন বলল, বাদল নামে তার এক মামা আছেন যিনি এফডিসির ক্যামেরাম্যান। খুব ভালো গাড়ি চালান। আমি আর মায়া ভাসনকে বললাম, ঠিক আছে মামাকে ডাক। মামা সিদ্ধেশ্বরীতে থাকতেন।
ফেনী বার্তা : : এভাবেই শুরু? হাবিবুল আলম: হ্যাঁ, এভাবেই শুরু। জুনের ৭ তারিখ। আমরা গাড়ি ছিনতাই করার সিদ্ধান্ত নিলাম। অপারেশন করব ইন্টারকন্টিনেন্টালে। এর আগে ভেতরে দেখে এসেছি।
ফেনী বার্তা : : গাড়ি ছিনতাই করলেন কোথা থেকে? হাবিবুল আলম: গুলশান থেকে ছিনতাই করার সিদ্ধান্ত নিলাম। গুলশান-১ এখনকার পিজা হাটের উল্টো দিকে মসজিদ আছে। সেখানে তখন জঙ্গল আর ছোট ছোট টিলা। গুটি কয়েক বাড়ি। ফাঁকা জায়গায় বসে আমি, মায়া, জিয়া, ভাসন এবং ক্যামেরাম্যান বাদল গল্প করছি। মজার কথা হলো, প্রথম দিন যে কয়টা গাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়েছি সব কয়টিই ভাসনের পরিচিত। প্রতিটি গাড়িই ওর চেনা। দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর আমরা ওই দিন চলে এলাম। পরের দিন ভাসনকে আমি বললাম, হায়দার ভাই নতুন ম্যাসেজ পাঠিয়েছে হাতিরপুলে আর্মির আনাগোনা লক্ষ করার জন্য। তুই ওই দিক সামলা। ভাসনকে সরানোই উদ্দেশ্য। ওইদিন ওকে ঠেকিয়ে রাখলাম। পরের দিন ৯ জুন মায়া, স্বপন, জিয়া এবং ক্যামেরাম্যান বাদল মিলে ফের গাড়ি ছিনতাইয়ের সিদ্ধান্ত নিই। ক্যামেরাম্যান বাদলকে বললাম, আপনার ভাগিনা যাবে না, আপনি রেডি থাকেন। ড্রাইভারসহ আমার নিজের গাড়ি নিলাম। ট্রার্ম হ্যারোল্ড একটি লাল গাড়ি ছিল আমার বাবার। বাদল ভাইকেও ড্রাইভারসহ তার গাড়ি নিতে বললাম। কারণ, গাড়ি ছিনতাই করলে আমাদের গাড়িগুলো যাতে করে ড্রাইভাররা নিয়ে আসতে পারে।
ফেনী বার্তা : : এসব করছেন, পরিবার তো অনুমান করতে পারছে? হাবিবুল আলম: অবশ্যই, পরিবার জেনে গেছে আমরা কেন ঢাকায় ফিরলাম। প্রচ্ছন্ন সমর্থন নিয়েই কার্যক্রম চালাচ্ছি। পরিবারের সমর্থন ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব হতো না।
ফেনী বার্তা : : এদিন কোথায় অবস্থান নিলেন? হাবিবুল আলম: এদিনেও একই জায়গায় দুটি গাড়ি নিয়ে অবস্থান নিলাম। আমাদের মাঝে ভাসন নেই। কিছুক্ষণ পর দেখি, আদমজীর কোনো এক কর্মকর্তার একটি নতুন গাড়ি ড্রাইভার চালিয়ে আসছে। গাড়িতে আর কেউ নেই। বাদলকে বললাম, এটি ঠেকাতে হবে। বাদল তার গাড়ি নিয়ে সামনে চলে গেলেন। গাড়ি মাঝখানে রেখে আমি পিছু অনুসরণ করলাম। গুলশান-২এর ৯০ নম্বর রোডে চলে এসেছি। রাশিয়ান কনস্যুলেটের কাছে আসতেই ড্রাইভার টের পেয়ে টার্ন নিতে চাইল। বাদল ভাই টের পেয়ে মেইন রাস্তাতেই ব্লক করে দিল। পরে গাড়ি থেকে নেমে বাদল ড্রাইভারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেই গাড়ি চালাতে লাগল। আমি পেছনে আসছি। স্বপন পিস্তল ঠেকিয়ে ড্রাইভারকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। ড্রাইভারের চোখ বাঁধা। এক পাশে মায়া, আরেক পাশে জিয়া। মাঝখানে ড্রাইভার। কিছুক্ষণ যেতেই অর্থাৎ শ্যুটিং ক্লাবের পশ্চিমে কালভার্টের কাছে আসতেই বাদল গাড়ি থামাল। আমি গাড়ি থেকে নেমে বাদলকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। মায়া বলল, ড্রাইভার চিনে ফেলেছে। নাম বলে দিচ্ছে। এখন কী করা যায়? আমি বললাম, কোনো ঝুঁকি নেয়া যাবে না। স্বপনকে বললাম, শেষ করে দে। পরে আমি ওই গাড়িতে উঠে গেলাম। জিয়া মাঝখানে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, কালভার্ট পার হয়ে ড্রাইভারকে চোখ বেঁধে রাস্তায় ফেলে দেব। চিনে ফেলায় বিপত্তি ঘটল।
ফেনী বার্তা : : এরপর? হাবিবুল আলম: গাড়ি নিয়ে সিদ্ধেশ্বরীতে বাদলের বাড়িতে গেলাম। সেখানে গিয়ে প্লান করলাম। জিয়া, মায়া এবং আমি গাড়ি থেকে নামব। পারলে স্বপন আমাদের ব্যাকআপ দেবে। ওর কাছেই একমাত্র ছয় রাউন্ড গুলিসহ একটি পিস্তল। আমাদের প্রত্যেকের কাছে চার-পাঁচটি করে গ্রেনেড। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। উদ্দেশ্য ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশন। ইন্টারকন্টিনেন্টালের পূর্বপাশে অর্থাৎ মিন্টো রোডে ঢুকতেই যে মোড় (এখন যেখানে ফোয়ারা) সেখানে আগে একটি গাছ ছিল। সিদ্ধেশ্বরী থেকে গাছের কাছে আসলে সাকুরা বার একেবারে নাক বরাবর। ইন্টারকন্টিনেন্টালে এখনকার বাহির গেট ছিল প্রবেশদ্বার। বাহির গেট এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আর এখনকার প্রবেশদ্বারটি সাধারণত বন্ধ থাকত। আমরা গাছের কাছে আসতেই দেখি, পুলিশের গাড়ি সাইরেন বাজিয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রবেশ করছে। তখন সব সরকারি গাড়ি আমেরিকান। জাপানি গাড়ি তখনও ওইভাবে আসেনি। সামনে পুলিশের গাড়ি। পেছনে তিনটি স্যাবোলেট গাড়ির বহর।
ফেনী বার্তা : : কারা ছিল গাড়িতে? হাবিবুল আলম: যখন ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢুকল তখন টের পেলাম এটি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টিম। একটি ছিল সাদা গাড়ি। আমরা ধীরে ধীরে গিয়ে আউট গেট এবং এখানকার বন্ধ গেটের মাঝামাঝি ফুটপাত ঘেঁষে গাড়ি থামালাম। দেখলাম, রাস্তা ঘেঁষে আড়াই-তিন ফুট দেয়ালের ওপর প্রচুর লোক বসে আছে। গাড়ির বহর দেখে তারা হাতে তালি দিচ্ছে।
ফেনী বার্তা : : তালি দিচ্ছে কেন? হাবিবুল আলম: টিমে টুপি পরা মানুষও রয়েছে। পাকিস্তানের পক্ষে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম এসেছে। আলোচনা হবে, টাকা দেবে, পাকিস্তানের পক্ষে সমাধান হবে এটি জেনেই লোকজন উচ্ছ্বসিত হয়ে হাতে তালি দিচ্ছে। আমরা যে রাস্তার ওপর একটি গাড়ি থামালাম এ ব্যাপারে আর কারও নজর নেই। স্বপন, মায়া, জিয়া এবং আমি নামলাম। প্রথম গ্রেনেড জিয়া নিক্ষেপ করল। ওরটা হয়ত বাইরে পড়ল। এর পরেরটা মায়া অথবা আমি মারলাম। এটি সিঁড়ির কাছে গড়িয়ে গেল। বিস্ফোরণ হতে সময় লাগবে মাত্র কয়েক সেকেন্ড। এরপর জিয়া আরেকটি মারল। সেটি গিয়ে সাদা গাড়িটির ভেতরে প্রবেশ করল। এটিই প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। গাড়ি বিকট শব্দ করে কয়েক ফুট উপরে উঠে ধপাত করে মাটিতে পড়ে যায়। এরপর আরও তিনটি বিকট শব্দ। সম্ভবত আমরা পাঁচ থেকে ছয়টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছিলাম। এর মধ্যে দুটির বিস্ফোরণ হয়নি। আমরা খুব আস্তে ধীরে গাড়িতে উঠলাম। বাদল ভাই ঠাণ্ডা মাথায় গাড়ি চালাচ্ছেন। সাকুরার সামন থেকে টার্ন নিয়ে পূর্বের জায়গায় আসতেই দেখি, পুরো হোটেল চত্বর ফাঁকা। রাস্তায় লুঙ্গি, টুপি, জুতা পড়ে আছে। আমরা কাকরাইল মসজিদের কাছে গেলাম। সেখানে গিয়ে বাদল ভাইকে বললাম, ‘ডেইলি মর্নিং নিউজ’ অফিসে যান। ‘মর্নিং নিউজ’ অফিসে গিয়ে গ্রেনেড নিক্ষেপ করলাম। এরপর বললাম, গ্রেনেড তো আরও হাতে আছে। চল মগবাজারে গোলাম আযমের বাসায় যাই। গোলাম আযমের বাসায় গিয়ে দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করছি।
ফেনী বার্তা : : বিস্ফোরণ হলো? হাবিবুল আলম: বিস্ফোরণ ঘটলে তো খুশি হতাম। দুঃখের বিষয় বিস্ফোরণ ঘটেনি। এই সময় আমরা ইন্ডিয়ার ওপর চটে গেলাম। বললাম, কী ফালতু গ্রেনেড দিয়েছে, বিস্ফোরণ ঘটে না। আমি আমারটার পিন খুলেছিলাম, এটি স্পষ্ট মনে আছে। বিস্ফোরণ হয়নি বলে এখনও আপসস করি।
ফেনী বার্তা : : রাস্তায় সেনাবাহিনী ছিল না? হাবিবুল আলম: ছিল, কিন্তু তখনও চেকপোস্ট বসেনি। ৯ তারিখের ঘটনার পর তাদের টনক নড়েছে। ঘটনার পরপরই বিবিসিতে নিউজ হলো যে, ঢাকা পাকিস্তানি আর্মির নিয়ন্ত্রণে নেই। তবে গোলাম আযমের বাড়িতে বিস্ফোরণ হয়নি বলে বিবিসি সংবাদ পেল না। এটি আমরণ দুঃখ থেকে যাবে, যা আমরা সাধারণ��� বলি না।
ফেনী বার্তা : : উদ্দেশ্য এটিই ছিল? হাবিবুল আলম: উদ্দেশ্য ছিল জানান দেয়া যে, সবকিছু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নেই। ওই ঘটনার পর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ফান্ড বন্ধ করে দেয়।
ফেনী বার্তা : : এরপর আবারও ভারত চলে গেলেন? হাবিবুল আলম: ১৭ জনের সবাই যাইনি। কেউ কেউ অপারেশন করছে। ঢাকায় নিয়মিত শুরু হয়ে গেছে। আমরা গিয়ে হায়দার ভাইকে বললাম, ইন্ডিয়ার এই দুই নম্বর গ্রেনেড আর দেবেন না।
ফেনী বার্তা : : আপনার বন্ধুরা যেদিন ধরা পড়ল, ওইদিন আপনি কোথায় ছিলেন? হাবিবুল আলম: ২৭ আগস্ট শাহাদত ভাই এবং আমি আরও গেরিলা সদস্য এবং অস্ত্রের জন্য ওপারে যাই। ২৫ আগস্ট ছিল অপারেশন। ওই অপারেশনে রুমিও ছিল।
ফেনী বার্তা : : কোথায় ছিল এই অপারেশন? হাবিবুল আলম: ধানমন্ডির ৪-এর ১৮ এবং ২০ নং রোডে। ২০ নং রোডে থাকতেন চাইনিজরা। ১৮ নং রোডে আর্মির ব্রিগেডিয়ার থাকতেন। সেখানে ৮ থেকে ১০ জন জোয়ান সারাক্ষণ ডিউটি করতেন। ওইদিন আমি গাড়ি চালিয়েছি। আমার বামদিকে ছিল বদি। বদির পেছনে ছিল কাজী কামাল উদ্দিন। রুমিও গাড়িতে। রুমির এটিই ছিল ঢাকায় প্রথম এবং শেষ অপারেশন।
ফেনী বার্তা : : এটিই কি গাড়ি ছিনতাই করে? হাবিবুল আলম: হ্যাঁ। গাড়িটি ছিল মাহফুজ আনামের বড় ভাই মাহবুব ভাইয়ের। সাদা রংয়ের গাড়ি। সামনে ছোট্ট ছেলে ড্যাস বোর্ড ধরে দাঁড়িয়ে। মাহবুব ভাই খুবই ফর্সা। দেখে প্রথমে মনে করেছি, কোনো বিহারি হবেন। আমরা তিনটার দিকে বের হয়েছি। বদি হাত উঁচিয়ে গাড়িটি থামাল। ওর হাতে বন্দুক। বদি ঠাণ্ডা মাথায় বলছেন, আপনি কি অবাঙালি? তিনি বলছেন, আমি বাঙালি। বদি বলছেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আপনার গাড়িটি দরকার। আপনি নামুন, না হলে আপনার ছেলেকে মেরে ফেলা হবে। আমরা অপারেশনে যাব। আর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আপনি থানায় খবর দেবেন যে, আপনার গাড়ি ছিনতাই হয়েছে। এর আগে খবর দিলে পরিণাম খারাপ হবে। আমরা তখন জানতাম না যে, তিনি মাহফুজ আনামের বড় ভাই। মাহফুজ আনাম আমাদের কাছে খুবই পরিচিত নাম। মাহবুব সাহেব সম্মতি দিলেন। তাদেরকে রিক্সায় উঠিয়ে দিলাম। কিছুদূর আসার পর ড্যাস বোর্ড খুলে দেখি লাইসেন্সে মাহবুব আনাম লেখা। ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি পাকিস্তানের কর্মকর্তা। তখন আমরা বুঝতে পারলাম। তবে আর কিছুই করার ছিল না। এরপর জিয়া, ছুল্লু ভাই, মুক্তার আরেকটি গাড়ি নিয়ে এলো। কারণ পরপর দুটি অপারেশন করার কথা। ধানমন্ডি অপারেশন করে গভর্নর হাউজ এবং পিলখানায় অপারেশন করার কথা।
ফেনী বার্তা : : কী ঘটল অপারেশনে? হাবিবুল আলম: প্রথমে ২০ নং রোডে গেলাম। দেখি কেউ নেই। ফিরে এলাম ১৮ নং রোডে। দেখি, ব্রিগেডিয়ারের বাসার সামনে আট জোয়ান বসে আড্ডা দিচ্ছে।
ফেনী বার্তা : : ভারী অস্ত্র নিয়ে? হাবিবুল আলম: পুরো প্রস্তুতি নিয়ে। আমার কাছে চাইনিজ এসএমজি। কাজী কামাল উদ্দিনের কাছে চাইনিজ। সবার কাছেই অস্ত্র। বদিকে বললাম, মাথায় গুলি করবে আর কাজী কামালকে বললাম, পেটে গুলি করবে। দুই লেভেলে গুলি করলে মিস হওয়ার কথা নয়। আমি ফায়ার বলার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু। সব কয়টি শেষ। ধীরে গাড়ি চালাচ্ছি। স্বপন পিছন থেকে আমার জামার কলার ধরে বলছে এই হারামজাদা আমি ফায়ার করব না? তাহলে গাড়িতে তুলেছিস কেন? বললাম ঠিক আছে, চল। ফের ২০ নং রোডে গেলাম। ৫ মিনিট অপেক্ষা করলাম। কোনো চাইনিজ নেই। স্বপনকে বললাম, যথেষ্ট হয়েছে। তোমার কপালে নেই। চল। গভর্নর হাউজে আরেকটি গাড়ির সঙ্গে মিলতে হবে। ৭নং রোড দিয়ে যখন নিউমার্কেট রোডে এলাম তখন দেখি রাস্তায় ব্যারিকেড বসে গেছে। চার-পাঁচটি গাড়ি ইতোমধ্যেই থামিয়ে চেক করছে। আমি স্বপনকে বললাম, তুমি কি চালাতে চাও। স্বপন বলল, হ্যাঁ। আমি স্বপনকে বললাম, দেখ সামনে একজন এলএমজি নিয়ে শুয়ে আছে। ওটাকে নিতে হবে। শেষ করতে না পারলে দুঃখ আছে। বদি বলছে, এ পাশে আরেকটা আছে। আমি বললাম, শেষ করা তোমাদের দায়িত্ব। তবে নিশ্চিত শেষ করতে হবে। ওরা থাম থাম বলছে। গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি। একজন গালি দিয়ে গাড়ির সামনে আসল। আমি লাইট বন্ধ করে ডান পাশের ইন্ডিকেটার দিয়ে থামানোর ভান করলাম। এরমধ্যেই স্বপন, বদি, কামাল ফায়ার শুরু করে দিয়েছে। গুলির গরম খোসা এসে আমার পিঠে পড়ছে।
ফেনী বার্তা : : আর্মিরা গুলি করল না? হাবিবুল আলম: ওরা বুঝতেই পারেনি যে, গাড়ি থেকে এভাবে গুলি হতে পারে। বুঝে ওঠার আগেই আমাদের অ্যাকশন হয়ে গেছে। আমি বলেছি, বামদিকে ইন্ডিকেটার দেখিয়ে ডান দিকে যাব। গ্রিনরোডে আসার বাঁক নিয়ে আমি নিউ মার্কেটের দিকে গেলাম। সায়েন্স ল্যাবরেটরির দেয়ালের কাছে আসতেই রুমি বলছে, জিপ আসতেছে। রুমি আর বিলম্ব করেনি। সঙ্গেই সঙ্গেই পিছনের গ্লাস ভেঙ্গে জিপটিকে লক্ষ্য করেই গুলি। আমি লুকিং গ্লাসে দেখলাম, জিপটি সজোরে গিয়ে একটি খাম্বার সঙ্গে ধাক্কা খেল। সম্ভবত চালকের গায়ে গুলি লেগেছিল।
ফেনী বার্তা : : পেছন থেকে আর্মিরও গুলি করার কথা? হাবিবুল আলম: আর্মি গুলি না করায় আমরাও অবাক হলাম। হয়ত আমাদের ধরার জন্যই গুলি করেনি। আমি রুমিকে বললাম, খালাম্মাকে বল তোর বাসার উল্টো দিকে আসতে। কারণ এই আর্মসগুলো রাখতে হবে। আমরা এলিফ্যান্ট রোড থেকে সরু রাস্তা দিয়ে রুমিদের বাড়ির সামনের গলিতে চলে এলাম। দেখি খালাম্মা তার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। অস্ত্রগুলো তার গাড়িতে উঠিয়ে দিলাম। তিনি বাসায় নিয়ে গেলেন। কাজী কামাল, বদিকেও নামিয়ে দিলাম। রাত আটটা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আমি আর স্বপন গাড়ি নিয়ে ভূতের গলিতে ঢুকলাম। ভূতের গলিতে একটি বাড়ির সামনে গাড়িটি রেখে আমরা চুপচাপ হেঁটে এএসএইচকে সাদেকের বাড়িতে চলে এলাম। রুমিকে রেখে বদি এবং কামালও একই জায়গায় চলে এসেছে। সেখান থেকে আমরা ধানমন্ডি চলে গেলাম। এটিই ছিল রুমির শেষ অপারেশন। রুমিরা ২৯ আগস্ট পাকিস্তানি আর্মিদের হাতে ধরা পড়ে যায়।
ফেনী বার্তা : : দেশ স্বাধীন হলো। এরপর খালেদ মোশাররফ এবং মেজর হায়দারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল? হাবিবুল আলম: দু’জনের সঙ্গেই নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায়। ওইদিন আমি আর শাহাদত ভাই বঙ্গভবনে গিয়েছি খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করতে।
ফেনী বার্তা : : কেন গেলেন? হাবিবুল আলম: বঙ্গভবনে গিয়েছি, খালেদ মোশাররফের সঙ্গে চেঁচামেচি করতে। আমরা গিয়ে বললাম, রেডিওতে কথা বলছেন না কেন? কিছু একটা করুন।
ফেনী বার্তা : : তিনি কী বললেন? হাবিবুল আলম: তিনি বললেন, বিচারপতি সায়েম সাহেবকে রাষ্ট্রপতি করা হচ্ছে। কাগজপত্র ঠিকঠাক করা হচ্ছে, আলোচনা করতে হচ্ছে। এসব শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তিনদিন থেকে রেডিওতে কোনোই কথা নেই। কিছু একটা ভুল হচ্ছে বলে, আমরা অনুমান করতে পারছি। হয়ত অভ্যন্তরীণ সমস্যা হচ্ছে। কাল কথা হবে বলে বেরিয়ে আসলাম। আমি শাহাদত ভাইকে নামিয়ে দিয়ে আমার বাসায় চলে এলাম। রাত ১২টার দিকে গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। শাহাদত ভাইয়ের বাসায় ফোন করছি কিন্তু কেউ ফোন তুলছে না। ভোর চারটায় শাহাদত ভাই আমার বাসায় এলেন। বললেন, ঘটনা খারাপ। সিপাহীরা জিয়ার পক্ষে বিদ্রোহ করছে। খালেদ মোশাররফ কোথায়, জানি না। এরপর ভোরে রেডিওতে মেজর জিয়ার ঘোষণা শুনলাম।
ফেনী বার্তা : : কী ছিল ঘোষণায়? হাবিবুল আলম: তিনি মুক্ত এবং ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন।
ফেনী বার্তা : : তখন খালেদ মোশাররফ কোথায়? হাবিবুল আলম: তখনও আমরা জানতে পারিনি যে খালেদ মোশাররফ কোথায় আছেন। দুপুরের দিকে জানতে পারলাম, তিনি নিহত হয়েছেন।
ফেনী বার্তা : : এমনটি ধারণা করেছিলেন? হাবিবুল আলম: দুটি বিষয় ধারণা করেছিলাম। তিনি যদি ফোর্থ বেঙ্গলে যেতে পারতেন তাহলে রক্ষা পেতেন। নতুবা নিহত হবেন। সংসদ ভবনের পাশে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের রাস্তায় তাকে ব্লক করা হয়। সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়।
ফেনী বার্তা : : মেজর হায়দার কোথায় ছিলেন? হাবিবুল আলম: তা-ও আমাদের জানা ছিল না। দুপুরের দিকে জানলাম, খালেদ মোশাররফের সঙ্গে মেজর হায়দার এবং কর্নেল হুদাও নিহত হয়েছেন।
ফেনী বার্তা : : লাশ দেখেছিলেন? হাবিবুল আলম: হ্যাঁ। খালেদ মোশাররফের একটি গুলি লেগেছিল।
ফেনী বার্তা : : খালেদ মোশাররফের লাশ জিপের পেছনে বেঁধে টানা হয়েছে বলে প্রচার রয়েছে। এর সত্যতা নিয়ে কী বলবেন? হাবিবুল আলম: আমার মনে হয় না, এটি সত্য। হায়দার ভাইকে স্টেপ করেছিল। কর্নেল হুদাকেও গুলি করা হয়।
ফেনী বার্তা : : লাশ দেখলেন কোথায়? হাবিবুল আলম: পরের দিন রাতে লাশ বাসায় নিয়ে আসা হলো। আমরা বাসায় গেলাম। সাপ্তাহিক: তখন সবই জিয়াউর রহমানের নিয়ন্ত্রণে? হাবিবুল আলম: হ্যাঁ। ড. জাফরউল্লাহ, হায়দার ভাইয়ের লাশ গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে পাঠিয়ে দিলেন।
ফেনী বার্তা : : আপনারা তো খালেদ মোশাররফের লোক হিসেবেই পরিচিত? হাবিবুল আলম: হ্যাঁ। মোটামুটি পরিচিত।
ফেনী বার্তা : : আপনাদের সমস্যা হলো না? হাবিবুল আলম: না। মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গেও আমাদের কথা হতো। তিনি যখন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ তখনও দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে।
ফেনী বার্তা : : কিন্তু আপনারা তো খালেদ মোশাররফ বা মেজর হায়দারের লোক বলেই পরিচিত? নিরাপত্তাহীনতা কাজ করেছে কি না? হাবিবুল আলম: আমার চেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন শাহাদত ভাই। কারণ খালেদ মোশাররফ, হায়দার ভাই, সফিউল্লাহ সবাই শাহাদত ভাইয়ের বিচিত্রা অফিসে যেতেন। জেনারেল জিয়াও যেতেন, তবে নিয়মিত না। জেনারেল জিয়ার সঙ্গেও শাহাদত ভাইয়ের ভালো যোগাযোগ ছিল। এ কারণে নিরাপত্তাহীনতা থাকলেও শেষ পর্যন্ত কিছু হয়নি।
ফেনী বার্তা : : সবচেয়ে কাছের দু’জন মানুষকে হারালেন। কেমন ছিল সে কষ্ট? হাবিবুল আলম: হায়দার ভাইকে কখনও স্যার বলিনি। তার অসাধারণ বিচক্ষণতার কারণেই বিশৃঙ্খল যুবকদের নিয়ন্ত্রিত প্রশিক্ষণ দিতে পেরেছিলেন। এটি সবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে সব দিক দিয়েই দক্ষ ছিল। একইভাবে খালেদ মোশাররফরও একজন নির্বাহী হিসেবে অন্য কারও সঙ্গে তুলনা হয় না। তারা নিহত হওয়ার পর আমি আর শাহাদত ভাই এক সপ্তাহ কারও সঙ্গে কথা বলিনি।
ফেনী বার্তা : : এর জন্য খালেদ মোশাররফের কোনো ভুল ছিল কি না? হাবিবুল আলম: তিনি হয়ত সেনাবাহিনীর মধ্যকার পালস (নাড়ি) ধরতে পারছিলেন না। তিনি রক্তপাতহীন একটি সমাধান চেয়েছিলেন।
ফেনী বার্তা : : তা কি সম্ভব ছিল? হাবিবুল আলম: ইন্টিলিজেন্ট অফিসাররা যে মারাত্মক ভুল করতে পারে, তা খালেদ মোশাররফ এবং মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে। চরম বোকামির কারণেই এমন পরিণতি হয়েছে বলে আমি মনে করি। আমরা বারবার অ্যাকশন নিতে বলেছি। কিন্তু নেয়নি। এ কারণেই কষ্টটা আরও বেশি। সাপ্তাহিক: খালেদ মোশাররফ ভারতের চর ছিলেন, এই অভিযোগ কতটুকু সত্য ছিল বলে মনে করেন? হাবিবুল আলম: এটি সত্য না। এই অভিযোগ কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনা। আমার মনে হয় না, এটি জেনারেল জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনা।
ফেনী বার্তা : : শেষ করি অন্য একটি প্রসঙ্গ দিয়ে। শেখ কামাল তো আপনাদের বন্ধু ছিলেন? হাবিবুল আলম: হ্যাঁ, শেখ কামাল আমাদের বন্ধু ছিলেন।
ফেনী বার্তা : : শেখ কামাল সম্পর্কেও নানা অভিযোগ শোনা যায়। হাবিবুল আলম: শেখ কামালের বিরুদ্ধে অভিযোগুলোরও খুব একটা সত্যতা আছে বলে আমার মনে হয় না। ব্যাংক ডাকাতি, মাস্তানির নানা অভিযোগই শেখ কামালের বিরুদ্ধে দেয়া হয়। শেখ কামালের স্বভাব ছিল, সবসময় সে সামনে দাঁড়াত। যে কোনো ঘটনায় সে সামনে থাকত। বন্ধুদের নিয়ে ঘুরত। দলে বলে চলা থেকে অনেকে তাকে মাস্তান বলে উপাধি দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে শেখ কামাল মাস্তান ছিল না। তবে তার কোনো কোনো বন্ধুর কিছু কিছু কাজ বা আচরণ হয়ত ঠিক ছিল না। যার দায় তাকে নিতে হয়েছে।
ফেনী বার্তা : : তাহলে ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগ উঠল কেন? হাবিবুল আলম: এটি সত্য নয়। এখনও শেখ কামালের দুই বন্ধু বেঁচে আছেন। শামসুল হক টুকু তো বিএনপি করে। শাহানও বেঁচে আছেন। তারাই বলুক শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতির উদ্দেশ্যে গিয়েছিল কি না। তারাও তো সঙ্গে ছিল। সোনালী ব্যাংকের সেই ম্যানেজারও বেঁচে আছেন।
ফেনী বার্তা : : গুলির ঘটনাও ঘটল? হাবিবুল আলম: আমরা শুনেছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা লুট হচ্ছে, তা জেনে শেখ কামাল বাধা দিতে গিয়েছিল। কে লুট করছে আর কে বাধা দিচ্ছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। আমরা যদি টের পেতাম যে, শেখ কামালের কাছে টাকা গিয়েছে, তাহলে আমরা তাকে ধরতাম। গুলি লাগার পর আমরা হাসপাতালেও দেখতে গিয়েছি। শেখ কামালের গাড়িতে যে চার জন ছিল তারা কেউ ব্যাংক ডাকাতি করতে পারে বলে মনে হয় না। যারা পারতেন তারা গাড়িতে ছিল না।