খাতায়-কলমে ‘টার্গেট’ ছিল ২৩। হয়েছে ১৮। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে এক বারের জন্যও খেদ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি তথাকথিত টার্গেট ‘মিস’ করার জন্য। বাংলার বিজেপি নেতৃত্বকে বরং অভিনন্দনই জানানো হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্ভেদ্য দুর্গে ধস নামিয়ে ১৮টি আসনে জিতে আসাটা ঠিক কী রকম ব্যাপার, মোদী বা শাহের কাছে এখন আর তা অজানা নয়। এ বার তাই বাংলাকে পুরস্কৃত করার তোড়জোড়ও শুরু। বাংলা থেকে অন্তত পাঁচ জন ঠাঁই পাচ্ছেন মোদীর মন্ত্রিমণ্ডলে, খবর বিজেপি সূত্রের।
রাজ্য বিজেপির একটি অংশ বলছে, বাংলা যদি পাঁচ মন্ত্রী পায়, তা হলে পূর্ণমন্ত্রী হচ্ছেন তাঁদের মধ্যে যে কোনও এক জন। বাকিরা হবেন প্রতিমন্ত্রী। আর পূর্ণমন্ত্রী যদি দু’জনকে করা হয়, তা হলে প্রতিমন্ত্রীর সংখ্যা কমবে, তিন জনের বদলে দু’জনকে প্রতিমন্ত্রী করা হবে। সে ক্ষেত্রে এ রাজ্য থেকে মোট মন্ত্রীর সংখ্যা পাঁচ থেকে কমে চার হয়ে যাবে।
তবে আর এক রকম জল্পনাও রয়েছে। উত্তরপ্রদেশকে বাদ দিলে যে রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে বিজেপি, তার নাম পশ্চিমবঙ্গ। এই অভূতপূর্ব উত্থানের কথা মাথায় রেখে মন্ত্রিত্ব বণ্টনের হিসেব বাংলার ক্ষেত্রে একটু শিথিল করা হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে এ রাজ্য থেকে দু’জন পূর্ণমন্ত্রী ও তিন জন প্রতিমন্ত্রী হতে পারেন।
আরও পড়ুন: আরও এক দফা পে কমিশনের মেয়াদ বাড়াল রাজ্য সরকার, তীব্র ক্ষোভ কর্মী মহলে
পূর্ণমন্ত্রিত্বের তালিকায় এ রাজ্যের যে সাংসদের নাম সর্বাগ্রে শোনা যাচ্ছে, তিনি বাবুল সুপ্রিয়। আসানসোলে গত বার তাঁর জয়ের ব্যবধান ছিল ৭০ হাজারের সামান্য বেশি। এ বার তা প্রায় ২ লক্ষ ছুঁয়ে ফেলেছে। বিদায়ী ক্যাবিনেটে প্রতিমন্ত্রী থাকা বাবুলকে তাই এ বার প্রোমোশন দেওয়ার কথা ভাবছেন বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব।
বাবুল নিজে অবশ্য এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। এ বার কি পূর্ণমন্ত্রিত্ব মিলছে? প্রশ্ন শুনে হেসেছেন আসানসোলের সাংসদ এবং বলেছেন, ‘‘কোনও মন্তব্য নয়।’’
পূর্ণমন্ত্রিত্বের তালিকায় স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসছে আরও দুটো নাম, যাঁদের মধ্যে যে কোনও এক জনের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে। তাঁরা হলেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং দলের জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য তথা এ রাজ্যে বিজেপির সবচেয়ে হেভিওয়েট মুখগুলির অন্যতম মুকুল রায়।
আরও পড়ুন: রাজনৈতিক অস্পৃশ্যতা ও সন্ত্রাসের শিকার বিজেপি, বারাণসীর সভায় বললেন মোদী
রাজ্য বিজেপির সভাপতি হওয়ার আগে দিলীপ সে ভাবে পরিচিত নাম ছিলেন না ঠিকই। কিন্তু সভাপতি হওয়ার পর থেকে বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে হু হু করে বেড়েছে তাঁর জনপ্রিয়তা। নানা মন্তব্যের জন্য অনেকগুলো বিতর্কে জড়ালেও কিন্তু তাতে দিলীপের জনপ্রিয়তা যে ধাক্কা খায়নি, মেদিনীপুর আসনে মানস ভুঁইয়ার মতো প্রার্থীর বিরুদ্ধে দিলীপের নিরাপদ ব্যবধানে জয়ই তা প্রমাণ করে দিয়েছে।
মুকুল রায়ও কিন্তু খুব অল্প দিনেই এ রাজ্যের বিজেপির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁর উপরে অনেকখানি ভরসা তো করেনই। লোকসভা নির্বাচনের পরে এ রাজ্যের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন যে, বিজেপির অভূতপূর্ব ফলাফলের নেপথ্যে মুকুল রায়ের ভূমিকা অনেকখানি।
প্রশ্ন হল, দুই হেভিওয়েটের মধ্যে কাকে বেছে নেবেন বিজেপি নেতৃত্ব? বিজেপি সূত্রের খবর, বাছাইয়ের কাজটা দিলীপ ঘোষ কিছুটা সহজ করে দিয়েছেন। তিনি কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব করতে খুব একটা আগ্রহী এখন নন, বরং রাজ্য বিজেপির সভাপতি হিসেবে আরও একটা মেয়াদে কাজ করতেই বেশি উৎসুক— এমন মতামত নেতৃত্বকে দিলীপ ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন বলে খবর।
আরও পড়ুন: লন্ডনে সম্পত্তি কেনা মামলায় রবার্ট বঢরার জবাব তলব, আগাম জামিন খারিজের আর্জি ইডির
দিলীপ ঘোষ যদি রাজ্য সভাপতি হিসেবে কাজ করতেই বেশি আগ্রহী হন, তা হলে মুকুল রায়কে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করার সিদ্ধান্ত নিতে আর খুব একটা ভাবতে হবে না বিজেপি নেতৃত্বকে। কিন্তু দিলীপ বা মুকুল কী ভাবছেন, তার উপরে ভিত্তি করেই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেবেন, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। নেতৃত্ব যাঁকে যে ভূমিকায় দেখতে চান, তাঁকে সেই ভূমিকাই পালন করতে হবে।
বাবুল এবং দিলীপ বা মুকুলের মধ্যে এক জন— এই দুই পূর্ণমন্ত্রী যদি বাংলা পায়, তা হলে রাষ্ট্রমন্ত্রী মিলবে আরও অন্তত দুটো। সে দৌড়ে অনেকগুলো নাম ভাসছে।
সর্বাগ্রে শোনা যাচ্ছে এস এস অহলুওয়ালিয়ার নাম। একাধিক বারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তিনি। মোদী ক্যাবিনেটে গত বারও ছিলেন দার্জিলিঙের সাংসদ হিসেবে। এ বার বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনেও সাঙঘাতিক লড়াই দিয়ে জিতেছেন, আসন ছিনিয়ে নিয়েছেন তৃণমূলের হাত থেকে। মোদীর মন্ত্রিসভায় তাঁর ঠাঁই না পাওয়ার কোনও কারণ সে ভাবে নেই। কিন্তু অহলুওয়ালিয়া মন্ত্রী হলে একই জেলায় চলে যাচ্ছে দুই মন্ত্রিত্ব। কারণ, যে পশ্চিম বর্ধমান জেলা থেকে অহলুওয়ালিয়া এ বার সংসদে গেলেন, বাবুল সুপ্রিয়ও সেই জেলারই সাংসদ।
উত্তরবঙ্গের আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতেই জিতেছে বিজেপি। সেখান থেকে কারও না কারও মন্ত্রী হওয়া বাঁধা। সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে যাঁর নাম, তিনি জন বার্লা। আদিবাসী এবং চা শ্রমিকদের মধ্যে অত্যন্ত পরিচিত নাম জন। তবে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে আসা প্রার্থী তথা জলপাইগুড়িতে জয়ী জয়ন্ত রায় বা সিপিএম বিধায়ক পদে ইস্তফা দিয়ে বিজেপির টিকিট নেওয়া তথা উত্তর মালদহে জয়ী খগেন মুর্মুর নামও উঠে আসছে মন্ত্রিত্বের সম্ভাবনা সংক্রান্ত আলোচনায়।
আরও পড়ুন: ইস্তফার সিদ্ধান্তে অনড় রাহুল, মানলেন সনিয়া-প্রিয়ঙ্কাও, নতুন নেতা সন্ধানের নির্দেশ
মন্ত্রিত্বে জঙ্গল মহলের কোনও প্রতিনিধিকেও রাখতে চাইছে বিজেপি। সে ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য সুভাষ সরকারের নাম। পেশায় চিকিৎসক সুভাষ সরকার রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি তো বটেই। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতো হেভিওয়েট প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে তিনি হইচইও ফেলে দিয়েছেন।
বাংলা থেকে অন্তত একটি মহিলা মুখকে মোদী মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেওয়া হবে বলে খবর। মহিলা মোর্চার রাজ্য সভানেত্রী তথা হুগলিতে রত্না দে নাগকে হারিয়ে চমকে দেওয়া লকেট চট্টোপাধ্যায়ের নামই সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে। তবে কেউ কেউ বলছেন, রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক তথা রায়গঞ্জ থেকে জিতে আসা দেবশ্রী চৌধুরীও দৌড়ে রয়েছেন।
শুধু আঞ্চলিক কোটা বা মহিলা কোটায় মন্ত্রী বেছে নেওয়ার কথা ভাবছে বিজেপি, এমন কিন্তু নয়। বাংলা থেকে কোনও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিকে মোদী মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলে খবর। চমকে দিয়ে উঠে আসছে মাফুজা খাতুনের নাম। প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক মাফুজা এ বার জঙ্গিপুর লোকসভা আসনে জোরদার লড়াই দিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী হিসেবে। তাঁর প্রচার এবং জনসংযোগের ধরন নজর কেড়েছে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরও। এ হেন মাফুজার কাছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে ফোনও এসেছে ইতিমধ্যেই। বায়োডেটা নেওয়া হয়েছে, তাঁর নামে কোনও মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে কি না, সে কথাও জানতে চাওয়া হয়েছে। তার পর থেকেই জল্পনা বাড়তে শুরু করেছে কুমারগঞ্জের প্রাক্তন বিধায়ককে নিয়ে। মন্ত্রিত্ব দেওয়া হলে তাঁকেও অবশ্য রাজ্যসভায় পাঠাতে হবে অন্য কোনও রাজ্য থেকে।